
ঊষার বাণী : ১৮ এপ্রিল ২০২২
/ফিচার/
এখন আর কানে বাজে না দোয়েল, টুনটুনির মিষ্টি সুর। বেশিরভাগই একাকী বিচরণ করে এরা। অত্যন্ত অস্থির মতি দুটি পাখি। কোথাও একদন্ড বসে থাকার সময় নেই। সারাদিন ওড়াউড়ি। এক দশক আগেও ছিল জাতীয় পাখি দোয়েল পাখির উপস্থিতি। বুক ফুলিয়ে গানের সুরে ডেকে বেড়াতো এরা। ক্রমশ এই শহরে বহুতল ভবন তথা নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জঙ্গল, গাছপালা ও ঘাসজমি কেটে ফেলায় স্বাভাবিক বাসস্থান সংকটে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে দোয়েল ও টুনটুনি পাখির সংখ্যা।
দোয়েল পাখি বাসা বাদতে দেখা যেত হিজল, বরুণ, কড়ছ (স্থানীয় ভাষায় লগ্গি গাছ) সহ পুরাতন গাছে, গাছের গর্তে অথবা গাছের ভিতরের ফাকা অংশে খর কুঠা দিয়ে বাসা বানাতে দেখা যেতো। আর টুনটুনি পাখি বেশির ভাগই ডুমুর ও কদম গাছের চারায় (যা মাটি হতে দেড় থেকে তিন ফুট লাম্বা গাছে মধ্যে) নতুন পাতায় বাসা বাদতে দেখা যেত। দেখা যেত ডুমুর ও কদমের পাতাকে বাজ করে মাকড়শার জালের সুতা দিয়ে সেলাই করে সুন্দর বাসা তৈরি করতে। (সেলাই করে সুন্দর বাসা তৈরি করার জন্য টুনটুনিকে দর্জি পাখিও বলা হয়)। এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। বানিয়াচং প্রেসক্লাব সভাপতি মোশাহেদ মিয়া বলেন, কয়েক বছর আগেও মানুষের ঘুম ভাঙতো পাখির ডাকে। তখন বোঝা যেত ভোর হয়েছে। পাখির কলকাকলিই বলে দিত এখন সকাল হয়েছে, শুরুহোক দৈনন্দিন কর্মব্যস্থতা। কিন্তু এখন দিন দিন যেন পাখির ডাক হারিয়ে গেছে, এখন গাছ-গাছালিতে পাখির ডাক নেই। কলকাকলি নেই। দুষ্কর হয়ে পড়েছে পাখির দেখা।
দোয়েল ও টুনটুনি পাখির যে বড়ই অভাব সেইটি বুঝতে পারা যাবে তখনি যখন দোয়েল ও টুনটুনি পাখি নতুন প্রজন্মদের বাস্তবে দেখাতে যাবে। শতচেষ্টা করেও সন্ধান মেলবে না। বানিয়াচঙ্গের মাঠে-ঘাটে বনে-জঙ্গল, গাছে গাছে একসময় জাতীয় পাখি দোয়েলসহ নানা ধরনের পাখি দেখা গেলেও কালের বিবর্তনে এখন আর চিরচেনা সেই পাখিগুলো দেখা যায় না। সাংবাদিক শেখ জওহর হোসেন ফাহদী বলেন, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতির সাথে জড়িত সেসব পাখির ডাক ও সুর মানুষকে মুগ্ধ করত, সেই পাখিই ক্রমান্বয়ই হারিয়ে যেতে বসেছে।
বিশেষ করে দোয়েল, টুনটুনি পাখির এখন আর দেখাই মিলছে না। প্রতিদিন সকালে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠত গ্রামের ঝোপে-ঝাড়ে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে সকালে ঘুম ভাঙ্গত । ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই খাবারের সন্ধানে ছুটে যেত মাটে ঘাটে, খেতে খামারে অসংখ্য পাখি। কয়েকজন বয়স্কলোকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দোয়েল টুনটুনিসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির শীষ আর শোনা যায় না। দুপুর ও সন্ধ্যায় বাঁশ ঝাড়ে, আমের ডালে, সজিনা গাছে, শিম গাছ, লাউ গাছ, ঝিংগা গাছের লতে, বাড়ির ছাদে যে পাখি দেখা যেত, সেই পাখি আর চোখে পড়ে না। শোনা যায় না পাখিদের কলকাকলি।
ময়মনসিংহ এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, আগে ময়মনসিংহ শহরের অধিকাংশ বাড়িতেই ছিল খাম ও সিলিং। কিন্তু এখনকার বাড়িগুলোতে সেগুলো না থাকায় বাসস্থান হারাচ্ছে অনেক প্রজাতির পাখি। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলেও মারা যাচ্ছে অনেক পাখি। তা ছাড়া জলাশয়ের অভাবেও পাখির সংখ্যা কমছে এই শহরে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয়তনে ময়মনসিংহ শহর বেড়ে চলেছে। এখন আর এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে মানুষ পৌঁছতে পারে না। তাই বাসস্থান হারাচ্ছে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলসহ পাখিকূল। অপরদিকে দোয়েল এবং টুনটুনি পাখির সংখ্যা কমে গেলেও চোখে পড়ার মত ঘন উপস্থিতি চড়ুই পাখিদের সংখ্যা। এদের কিচির-মিচির সুরে ঘুম ভাঙে ময়মনসিংহবাসীর।
চড়ুই পাখিদের পাল এখন মহাব্যস্ত হয়ে মাঠে, বাড়ির আঙিনায় আর চাতালগুলোতে ভিড় জমিয়ে থাকে। সংখ্যার বিবেচনায় এরা এখনও পাখিপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। ভোরের মৃদু বাতাসে চড়ুই পাখিদের দৌড়ঝাপ প্রকৃতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে ময়মনসিংহের পথ-প্রান্তরে। পাখি না থাকায় মানুষও সমস্যায় পড়বে উল্লেখ করে ময়মনসিংহের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, পাখি কমে যাওয়ায় শুধুই যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে তা নয়। ময়মনসিংহে ফল গাছের সংখ্যা কমছে, তাই সমস্যায় পড়ছে পাখি। পোকা-মাকড়ের সংখ্যাও কমে গেছে। পাখিদের খাবারের অভাবও দেখা যাচ্ছে। পাখির বাচ্চারা বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকামাকড় খায়। পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের জীবনধারণও সঙ্কটে।
ঊষার বাণী/ এএইচ/ ২০২২