
ঊষারবাণী ডেস্ক : ০৮ এপ্রিল ২০২২
হলদে গ্রামবাংলার চিরচেনা একটি পাখি ‘বউ কথা কও’। কোনো কোনো অঞ্চলে ‘কুটুম’ পাখি বা বেনে বউ নামেও পরিচিত। সুরেলা কণ্ঠের পাখিটি নিজের গুণেই মানুষের নজর কাড়ে। সব ঋতুতে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ মাতিয়ে রাখে পাখিটি। বাড়ির আঙ্গিনার বাঁশঝাড়, বট ও পেয়ারা গাছের ডালে বসে ডাকাডাকি করে। শেষ বিকেলের লাজুক আলোয় গাঁয়ের বাড়ির উঠোনে বলা নেই কওয়া নেই গাছের শাখা থেকে ভেসে আসে মিষ্টি সুর। অল্প বিরতি দিয়ে ডাকতেই থাকে ‘বো কো টা কো..বো কো টা কো …’ । গাছের দিকে তাকালে চোখে পড়ে নাচছে হলদে পাখি। পাখিরা কী বলছে সুরে সুরে ! ওই পাখির কণ্ঠের সুরে কিছু বাংলা শব্দ জুড়ে দিলে এমনটি দাঁড়ায়- ‘বউ কথা কও’। শুনে লাজরাঙা নববধূ অবগুণ্ঠন খুলে মিষ্টি হেসে মনে মনেই উত্তর দেয় ‘কু উ….কু উ’। হাজার বছর ধরে বাংলার নিজস্ব এই পাখি ওদের ভাষায় সুরের নামেই পরিচিতি পেয়েছে- বউ কথা কও। তবে এই নামের সঙ্গে অঞ্চলভেদে আরও চারটি নাম যোগ হয়েছে হলুদ সোনা বউ, কুটুম পাখি বেনে বউ ও কুটুম বউ।
ডানা ও পুচ্ছে কালো রঙসহ দেহের বাকি অংশ সোনালি হলুদ রঙের চোখে স্পষ্ট কালো রেখা দেখা যায়। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাসে ও অধিক সবুজ রঙের। এটি কর্কশ স্বরে ‘চীয়া’ বোলে ডাকে এবং ‘পীলোলো’ শব্দে শিস দেয়। কীটপতঙ্গ, ফল ও ফুলের নির্যাস আহার করে। এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে বাসা বাঁধে। ২-৩টি ডিম পাড়ে। বাসার সব কাজে স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে অংশ নেয়। দেশের উত্তর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।
মাথা, গলা ও ঊর্ধ্ব-বক্ষ, ডানা ও পুচ্ছে কালো রংসহ দেহের অবশিষ্ট অংশ উজ্জ্বল সোনালি হলুদ রঙের। ঠোঁট গোলাপি ও চোখ গাঢ লাল। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম, তবে স্ত্রীর মাথার কালো রং অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাসে। এই পাখি কর্কশ স্বরে ‘কোয়াক’ বোল তুলে ডাকে।
গায়ের পালক উজ্জ্বল হলুদ। এই পাখিটি আকৃতিতে অনেকটা শালিকের মতো। দৈর্ঘ্য ২৪ সেন্টিমিটার। গায়ের পালক উজ্জ্বল হলুদ। লেজ ও পাখার অগ্রভাগের পালক কালো। গলা ও মাথার রং চিকচিকে কালো হলেও ঠোঁট ও চোখ লাল টকটকে। আর পা দুটো হালকা কালো। এরা সাধারণত ঝোপ-ঝাড়ে, শুকনো ডালপালা, খড়কুটো বা আগাছা দিয়ে গাছের ডালে বাসা বানায়। বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এদের প্রজনন মৌসুম। সাদা রঙের বাদামি ফোঁটাযুক্ত তিন-চারটি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়ে পাখি দুজন মিলে ডিমে তা দিয়ে ১৫ থেকে ১৭ দিনে বাচ্চা ফোটায়। লম্বা ঠোঁটওয়ালা হলদে পাখিটি পোকা-মাকড় ও ফল খায়। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পাখিগুলোর বাস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপকরণ আমাদের পাক-পাখালি। কিন্তু মানুষের আগ্রাসী আচরণে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনজঙ্গল ও দেশীয় গাছ বৃক্ষলতা। ফলে জীববৈচিত্র্যের বড় ক্ষতি হচ্ছে। বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে হলদেসহ দেশীয় প্রজাতির সব পাখি। তবে এরা এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।
পাখিপ্রেমী মুড়ালী গ্রামের সানাউর রহমান বলেন, মানুষের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বট, আম, জাম, চামকাঁঠালসহ বড় বড় গাছ উজাড় হয়ে গেছে। ফলে দেশীয় প্রজাতির অনেক পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় হলদে পাখি খুবই কাছাকাছি দেখা যেতো। কিন্তু এখন এদের কম দেখা যায়। মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গল উপজেলার বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, আমাদের প্রকৃতি থেকে পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষলতা হারিয়ে যাওয়ায় কৃষক বন্ধু পাখিটি কমে গেছে। ফসলের ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু পাখিটি কমে যাওয়ায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। গ্রামবাংলায় সচরাচর চোখে পড়ে না পাখিটি। পাখি বিশেষজ্ঞ টি-প্ল্যান্টার পঞ্চগড়ের ইবাদুল হক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হলদে পাখি বা বেনেবউ পাওয়া যায়। চিরচেনা এ পাখি বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সংরক্ষণে সবার সহযোগিতা জরুরি।
ঊষারবাণী/আরএ/এএইচ/২০২২